জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পৃথক বিচার বিভাগীয় ও সচিবালয়ের দাবী

Date: 2025-07-26
news-banner

অনলাইন ডেক্স: 

বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, বিচারকদের পদোন্নতি ও নিয়োগে বৈষম্য, বাজেট সংকট এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তাদের দাবি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করতে হবে। তাছাড়া একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং সুপ্রিম কোর্টের অধীনে বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ন্যস্ত করতে হবে।

শনিবার সকাল ৯টায় ময়মনসিংহ নগরীর সিলভার ক্যাসেল রিসোর্টে ‘জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার ও পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) আয়োজিত এই সভায় ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলাসহ কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। সভার শুরুতে বিচারকরা শ্রদ্ধার সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহতদের স্মরণ করেন। বক্তারা তাদের আত্মত্যাগকে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করেন। আলোচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নির্বাহী বিভাগের ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বক্তারা বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা অপরিহার্য হলেও, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ এখনো নির্বাহী বিভাগের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। বিচারকরা অভিযোগ করেন, তাদের পদ বৃদ্ধি, পদ-সৃজন এবং আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষমতা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকায় বিচারিক কর্ম ঘণ্টার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে না। এতে বিচারিক প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন জ্যেষ্ঠতা, মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলা আদালত থেকে সমতা রক্ষা করে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন তারা। এ ছাড়া, বক্তারা বিচার বিভাগের বাজেট সংকট এবং নির্বাহী বিভাগের উপর পূর্ণ নির্ভরতাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অর্থনৈতিক দুর্বলতা আদালতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বিচারিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। উপস্থিত বিচারকরা বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক বাজেট কাঠামো এবং স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতা তুলে ধরেন। বিচারকদের মর্যাদা ও আর্থিক প্রণোদনা তাদের সাংবিধানিক গুরুদায়িত্বের সমতুল্য হওয়া উচিত বলেও তারা মত প্রকাশ করেন। ২০০৯ সালের স্কেলে স্থবির হয়ে থাকা জুডিশিয়াল ভাতার অচলাবস্থার সমালোচনা করে একটি পৃথক ও স্বাধীন পে-কমিশন গঠনের দাবি জানানো হয়। এসময়, বিচার বিভাগের উপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিচারকদের বদলি, নিয়োগ, পদায়ন এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়াবলী বহুলাংশে নির্বাহী বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকায় শাসকশ্রেণি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অযাচিত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এর ফলে, জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে। এই সংকট নিরসনে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নির্বাহী ও আইনসভা থেকে এর কার্যকর পৃথকীকরণ অত্যন্ত জরুরি বলে বক্তারা মনে করেন।

বক্তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের মত দেশে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো বিদ্যমান আছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও বাংলাদেশে বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিচারকরা জোর দিয়ে বলেন, বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন মামলার রায়ে হাই কোর্ট বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার নির্দেশনা দেন, যা আপিল বিভাগ ১৯৯৯ সালে বহাল রাখেন। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগকে পৃথক ঘোষণা করা হলেও রায়ের ১২ দফার মধ্যে একটি মাত্র দফা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। বিচার বিভাগের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পৃথক সচিবালয় এবং বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। সংবিধানের ১০৯ ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের উপর হাই কোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং বিচারিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও, ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছে। কিন্তু এটি এখনো নির্বাহী বিভাগের পরামর্শে প্রয়োগ হয়। এর ফলে বিচারকদের পোস্টিং, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি এবং শৃঙ্খলামূলক বিষয়গুলো এখনো নির্বাহী বিভাগের অধীনে রয়ে গেছে। এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মূলনীতিকে ব্যাহত করছে। বক্তারা ১১৬ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করে এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার এবং একটি পৃথক ‘বিচার বিভাগীয় সচিবালয়’ গঠনের আহ্বান জানান। বিচারকরা আশা প্রকাশ করেন, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বিচার বিভাগের সংস্কারে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে প্রদত্ত অভিভাষণে বিচার বিভাগের জন্য যে ঐতিহাসিক রোডম্যাপ তুলে ধরেন তার উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারকরা দাবি করেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ এখতিয়ার সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ছাড়া, ‘সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণীত হয়েছে এবং প্রধান বিচারপতি নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মত বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। বক্তারা জোরালোভাবে তুলে ধরেন যে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা, দ্রুততম ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং জনসাধারণের আস্থা ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে এই প্রত্যাশা পূরণে যুগান্তকারী অবদান রাখতে হবে। এ সময় ‘ইয়ং জাজেস ফোরাম’ এর সক্রিয় ও সাহসী পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানিয়ে বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে একটি গতিশীল ও গণমুখী সংগঠন প্রতিষ্ঠার পথে তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। পাশাপাশি বিচারকরা এই সংগঠনকে বিচার বিভাগের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি কার্যকর ‘প্রেসার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল খুলনার বিচারক মো. আমিরুল ইসলাম।


advertisement image

Leave Your Comments